0 comments 0 views
ছোটো থেকেই একটা বিষয় খেয়াল করতাম। তা হলো, আমার বাবা কোনোদিন আমার নানুর বাড়ির মানুষদের সহ্য করতে পারতেন না। কারণটা কি ছিলো সেটা পরবর্তীতে আম্মার মুখেই শুনতে পাই।
নানুর বাড়ির লোকজনদের অপচ্ছন্দের মূল কারণ ছিলো আম্মার সাথে বিয়েটা। আমার নানুর ছোটো ভাইয়ের মেয়ের সাথে বাবার বিয়ে ঠিক হয়। কিন্তু বিয়ের দিন খালাম্মা তার প্রেমিকের সাথে পালিয়ে যায়। নানুভাই সেদিন কোনো পথ খুঁজে না পেয়ে আম্মাকে কনে সাজে বসায়।
এখনকার মতো আগের যুগের মানুষরা ছিলো না। নাতো তাদের আচার অনুষ্ঠান এমন ছিলো। তখন বেশিরভাগ বউদের সোজা বাসর ঘরেই দেখতো তাদের স্বামীরা। আম্মার বেলাতেও ঠিক তাই হয়। যদিওবা খালাম্মাকে দাদা আর বাবা আগে দেখে। কিন্তু বিয়ের আসরে নানু আম্মাকে তার পরিবর্তে বসিয়ে আর কাউকে দেখায়নি।
বাবা যখন আম্মাকে প্রথম বাসর ঘরে দেখেন তখন নানুদের জালিয়াত, ঠকবাজ বলে দোষারোপ করতে থাকেন। আম্মা দেখতে ততোটাও সুন্দর না হয়তো এটাই তার প্রধান কারণ।
আমার আম্মা এ সংসারে অনেক কষ্টই সহ্য করেছেন। রাতের রাত নেই আমরা আম্মার ঘর থেকে চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ পেয়েছি। ভয়ে কুঁকড়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকতাম দুই বোন। মাঝরাতে আম্মা আমাদের ঘরে আসতেন কাঁদতে কাঁদতে। আমরা বুঝতাম না তখন আদৌ আমার আম্মার দোষটা কোথায় ছিলো।
বাবা সবসময় বদমেজাজী হয়ে থাকতেন। আমাদের সাথে কথা বলার সময়েও। আমরা খুব ভয় পেতাম তাকে। ছোটোবেলায় দেখতাম বান্ধবীরা স্কুলে এসে তাদের বাবাকে নিয়ে গল্প করতো। প্রতিটা মেয়েই নাকি তাদের বাবার কাছে রাজকুমারী। অথচ আমি বা আমার ছোটো বোন কোনোদিনো সেই ভালোবাসা পায়নি বাবার কাছে।
শুনেছি আম্মাকে বিয়ে করে আনার পর বাবা আর কোনোদিনো নানুর বাড়ি যাইনি। এমনকি আমাদেরও কখনো যেতে দেয়নি। আমার নানু যখন মারা যায় আম্মা ঘরের মধ্যে গলা কাটা মুরগির মতো দাফাতে থাকে, তবুও পাষান মানুষটা আম্মাকে যেতে দেয়নি সেদিন।
কিছুদিন পর নানীও মারা যায়। তখন থেকেই শুরু হয় আরো বেশি অত্যাচার। আম্মার রান্না থেকে শুরু করে সবকিছুতেই ভুল ধরেন তিনি। এছাড়া আমাদের সামনেও গায়ে হাত তুলতেন।
আমার আম্মার শরীরের প্রায় জায়গাতেই ওই মানুষটার দেওয়া কষ্টের দাগ। এতকিছুর পরেও সে শান্তি পায়নি। আমার ছোটো ভাইটা হওয়ার তিন বছর পর সে পরকীয়া করে পালিয়ে যায় আমাদের ফেলে। একজন মেয়ে মানুষের পক্ষে কি সম্ভব ছিলো তিনটা ছেলে মেয়েকে একা মানুষ করা?
তবুও আমার আম্মা আমাদের জন্য নিজের জীবন তিলে তিলে শেষ করে দিয়েছেন।
আমার মামারা যথেষ্ট ভালো মানুষ। শেষ বেলায় তারাই আমাদের দায়িত্ব নেন। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস দেখুন, যাদের বাড়িতে জন্মের পরে একটা বেলার জন্যেও যেতে দেননি আমার বাবা। অথচ সেই বাবা আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার পর থেকে আমরা সেই মানুষগুলোর কাছেই এত বড় হই।
আমার বিয়ে বার বার ভেঙ্গে যাওয়ার এটাই কারণ। এই সমাজে বাবা ছাড়া মেয়েদের বিয়ে হওয়া খুব কঠিন। আপনার পূর্বে যারা কথা বলতে এসেছিলো প্রত্যেককেই সত্যটা বলেছি।
এই নিয়ে সাতবার কোনো পাত্র-পক্ষের সামনে বসে আছি। আমি জানি আপনারাও বাসায় গিয়ে না করে দেবেন। তাতে কোনো সমস্যা নেই আমার। আমি যে সত্যকে গোপন করে বিয়ে করবো না শুধু এটাই জানি।
-আমাকে কি আপনার পচ্ছন্দ হয়েছে?
এতগুলো কথা শোনার পরেও আমার মুখোমুখি বসা পাত্রের মুখে এই কথাটা শুনে একটু না, বেশ অবাক হলাম। আমাদের অতীত জানার পরে কেউ আর রাজী হয়নি আমায় বিয়ে করতে। আম্মা,মামারা আমায় বার বার বলেছেন এসব কথা কাউকে না বলতে। কিন্তু আমি চাইনি মিথ্যা দিয়ে বিয়ের মতো পবিত্র সম্পর্কটা শুরু করতে। প্রথম থেকেই বিয়েতে আমার যতটা না অমত ছিলো তারচেয়ে বেশি ভয় কাজ করতো। চোখের সামনে ভেসে উঠতো আম্মাকে মারধরের নির্মম দৃশ্যগুলো। মামীরা অনেক ভাবে বোঝাতেন আমায়। আর আম্মার শরীরটাও ভীষণ খারাপ, তারওপর আমার ছোটো আরেকটা বোনও আছে। ভাইটার কথা বাদই দিলাম। মামারা নানান জায়গা থেকে সমন্ধ আনলেও বাবার বিষয়টা শুনে আর রাজী হতো না কেউ।
-কিছু বলছেন না যে? তাহলে কি নিরবতাকেই হ্যা সূচক উত্তর ধরে নেবো?
আমি কিছু বলার আগেই উনি মুচকি হেসে চলে গেলেন।
বিকালের দিকে মেজো মামা মোবাইলে কথা বলা শেষে বুবু বুবু বলে হাঁকডাক শুরু করেন। আম্মা রান্নাঘর থেকে চাউলের গুড়া মাখা হাত নিয়েই বেড়িয়ে আসেন উঠোনে,
-কি হয়েছে ভাই?
–বুবুরে পিঠা চিঁড়া বেশি করে বানাও। নতুন আত্মীয় এলো বলে।
-আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না।
–ছেলের পচ্ছন্দ হয়েছে আমাদের মেয়েটাকে। আর পরশু অর্থাৎ শুক্রবারেই বিয়ের দিন ধরেছে তারা।
-আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ আমার মেয়েটার দিকে এতদিনে মুখ তুলে তাকালেন…
দেখলাম আম্মা আর কোনো কথা বলতে পারলেন না। চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে।

আজ বৃহস্পতিবার রাত।

ডান হাতে মেহেদী পড়িয়ে দিচ্ছে আমার মামাতো বোনেরা। বিছানায় পড়ে থাকা ফোনটা ভাইব্রেশনে কেঁপে উঠলো। আমি ফোনটা বাম হাতে নিয়ে দেখলাম অপরিচিত নাম্বার। রিসিভড করে সালাম দিতেই ওপাশ থেকে খুব নম্র স্বরে ভেসে আসলো,
-ওয়া আলাইকুমুস-সালাম…কেমন আছেন?
–আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি কে বলছেন?
-আপনার ভালো মনের মানুষ।
আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না উনি কে। কিন্তু আমি যে সর্বদা ভালো মনের মানুষকে প্রার্থনা করতাম উনি সেটা কিভাবে জানলেন? কৌতুহলের বশত প্রশ্নটা ছুঁড়লাম তার দিকে। তিনি উত্তরে বললেন আমার আম্মার থেকে শুনেছেন। আম্মার সাথে কথা বলার পরেই নাকি আমায় কল করেছেন।
আম্মা যখন মাঝে মাঝে খুব করে কাঁদতেন, আমি আম্মাকে শান্তনা দিয়ে বলতাম চিন্তা না করতে৷ আল্লাহ তায়ালা আমাদের জীবনে ভালো মনের একজন মানুষকেই পাঠাবেন। হয়তো দেরিতে তবে নিশ্চয়ই পাঠাবেন।
কে বলে আল্লাহ তায়ালা প্রার্থনা কবুল করেন না? আমিতো সর্বদা এমন একজন ভালো মনের মানুষকেই প্রার্থনা করতাম। ছোটো থেকে আম্মার সাথে হওয়া অত্যাচারগুলো দেখে দেখে মনের মধ্যে একটা আতংক ভর করে থাকতো সবসময়। ভাবতাম সত্যিই কি সব পুরুষ মানুষ’ই খারাপ হয়? সবাই কি আমার বাবার মতো আম্মার ওপর অন্যায় করা পুরুষদের মতোই হয়?
কিন্তু না, সব পুরুষ এক হয় না। কিছু কিছু পুরুষ আমার ভালো মনের মানুষটার মতোও হয়। যাদের ওপর আস্থা রাখা যায়। যারা শুধু একজন মানুষকে সকল কিছুর উর্ধ্বে একজন মানুষ হিসেবেই মূল্যায়ন করতে জানে, ভালোবাসতে জানে।
 প্রার্থনা 
লেখিকাঃ- সোনিয়া শেখ 
লেখার তারিখঃ-  ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ 
প্রকাশিত ওয়েবসাইট- লেখক ও ব্লগার 
Md Efaz
Web Developer
Narayanganj Bangladesh
I am a dedicated WordPress developer with 4 years of experience on Fiverr. I specialize in developing all kinds of websites and landing pages, ensuring they are professional, responsive, and visually appealing. My goal is to bring your vision to life, whether it's a business site, e-commerce store, portfolio, or any other web solution. Let's work together to create a website that perfectly fits your needs and stands out in today’s digital landscape.
 

Leave a Comment