গল্প
আপনজন
✍ লেখিকা সোনিয়া শেখ
প্রচন্ড মাথা ব্যথা নিয়ে বিকেলের দিকে বিছানায় শরীরটা একটু এলিয়ে দিতেই কখন যে চোখ লেগে গেছে বুঝতে পারিনি। আমার মাথা ব্যথার কারন ‘মাইগ্রেন’ নামক একটা রোগ আছে।যখন ব্যথা করে এতো অসহ্য লাগে চোখ মেলে তখন আলোটাই সহ্য করতে পারি না। তাই রুমের লাইট টা অফ করে,জানালার পর্দা টানিয়ে একটু শুয়েছিলাম। এর মাঝে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না।
কারো হাতের ঠান্ডা স্পর্শ কপালে পড়তেই আবছা আলোয় চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি আমার শ্বাশুড়ি মা।
মা কে দেখেই হুড়মুড় করে শোয়া ছেড়ে বসে মাথার আঁচলটা ঠিক করতে লাগলাম।
মা কিছুটা বারণ করতে করতেই বললেন,
-এতো তারাহুরো করছো কেন বউমা? আমিইতো এসেছি রুমে অন্য কেউতো না।
–না মা আসলে এতো মাথা ব্যথা করছিলো কখন যে ঘুমিয়ে গেছি বুঝতেই পারিনি। তুমি বলো কি লাগবে তোমার আমি এক্ষুনি করে দিচ্ছি।
-আমি কি এখন একবারও বলেছি আমার কিছু লাগবে?
–তাহলে বাবা?বাবার কি কিছু লাগবে? বাবা কি ফিরেছে বাজার থেকে?
-নারে বাবা না, তোমার বাবা এখনো ফেরেনি বাজার থেকে। সে তো মনে হয় চায়ের দোকানে আড্ডায় মেতে আছে এখনো ফেরার সময় হয়নি তার।
আমি এসেছিলাম এই ঔষধটা খাওয়ার নিয়মগুলো ভুলে গেছি সেটাই দেখাতে। এসে দেখি তুমি এই অসময়ে ঘুমিয়ে আছো। চুলগুলো কেমন শুকনো তৈল ছাড়া এলোমেলো হয়ে আছে মাথায় হাতটা দিতেই উঠে পড়লে। মাথা ব্যথাতো করবেই মাথায় সারা দুনিয়ার চিন্তা নিয়ে ঘুরলে মাথা ব্যথা করবে না? এখন সব কথা রেখে আসোতো একটু এইদিকে আমি ভালো করে তৈল দিয়ে দিচ্ছি।
শ্বাশুড়ি মায়ের কথাটা শুনতেই আমার মায়ের কথা মনে পড়ে গেলো। মা ও তো এভাবে হাজারটা কথা শুনিয়ে তৈল দিয়ে দিতো। আমার মাথা ব্যথা হলেই মা বকতো আর বলতো এতো কিসের চিন্তা করি? অথচ আমার যে ওটা একটা রোগ সেটাই বার বার ভুলে যেতো।আজকে শ্বাশুড়ি মায়ের কথাটাও ঠিক মায়ের সেই লাইনটার মতো কানে বাজলো। আমি একটু আমতা আমতা করে বললাম,
মা থাক না তোমার কষ্ট করতে হবে না, আমি একাই তৈল দিতে পারবো।
মা খানিক চোখ রাঙ্গিয়েই বললো,
না থাকবে না। এতো বড় বড় চুলে একা একা তৈল দেওয়া যায় নাকি?আর তুমি কখনো একা তৈল দাওনি সেটাও আমি জানি। কতদিন হলো এ বাড়িতে এসেছো এখনই যদি এমন অবস্থা হয় তাহলে আমরা বেয়াই বেয়াইনের কাছে মুখ দেখাবো কেমন করে? তারাতো ভাববে আমরা তাদের মেয়ের কোনো যত্নই নেয়নি।
আমি আর কিছু না বলে চুপচাপ মায়ের সামনে গিয়ে মেঝেতে বসে পড়লাম। মা চুলগুলো সুন্দর করে আলাদা করতে করতে মাথার তালুতে তৈল দিতে লাগলো। আমি চোখ বন্ধ করে আবিষ্কার করতে লাগলাম আমার মায়ের হাতের স্পর্শগুলো। দু এক ফোঁটা জল আমার অজান্তেই চক্ষুদয় ভেদ করে বেড়িয়ে আসলো।
বিয়ের আগে কম বেশি প্রায় সকলের মুখেই শুনতাম শ্বাশুড়ি কখনো মায়ের মতো হয় না। কিন্তু আমি বলতাম মায়ের মতো কেউ হয় না তবে মায়ের মতো কাউকে ভালোবাসলে তাকে মা ভাবাটা কি খুব বেশি অন্যায়ের হয়ে যায়? আমার বান্ধবীরা মুখ বেঁকিয়ে তখন বলতো, বিয়ে হয়নিতো এখনো তাই জানিস না। হোক একবার বিয়ে দেখবি শ্বাশুড়ি কারে কয়। আমি ওদের কথায় খুব একটা ভয় পেতাম না। ভাবতাম হয়তো ওদের মায়ের মতো করে আর কাউকে নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করে না তাই ওরা শ্বাশুড়ি কে শ্বাশুড়ির অবস্থানেই রেখেছে। যদিওবা দু একটা ব্যতিক্রম বাদে। তবে আমার ইচ্ছাটা প্রবল ছিলো। নিজের মা বাবার পরে শ্বশুর শাশুড়িকেও মা বাবার জায়গাতে রেখে ভালোবাসা। হয়তো সৃষ্টিকর্তা পবিত্র ইচ্ছাগুলো পূর্ণ করে দিতেই এমন শ্বশুর শাশুড়ির ঘরে পাঠালেন। আমি সবসময় একটা কথায় শুধু ভাবতাম শ্বশুর শাশুড়ি কে যদি বাবা মায়ের মতো করে একটু দেখতে পারি সেই নজরে একটু ভালোবাসতে পারি তাহলে ক্ষতি কোথায়? বরং লাভ টা আমারই,কেননা কিছু পেতে হলে কিছুতো দিতেই হয়।যদি তাদেরকেই সু নজরেই না দেখতে পারি তাহলে আমি কিভাবে তাদের ভালোবাসা পাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করতে পারি? এমন নিছক অবাঞ্ছিত ইচ্ছা কখনোই যে পূরণ হওয়ার নয়।
এখন আমার সেইসব বান্ধবীদের সাথে দেখা হলে ওরাই বলে আমার নাকি ভাগ্যটা খুব ভালো।তাইতো এমন ভালো শ্বশুর শাশুড়িসহ স্বামী সংসার পেয়েছি।
সত্যিই আমার শ্বশুর শাশুড়ি অনেক ভালো মনের মানুষ। এ বাড়িতে আসতে না আসতেই তা আমি বুঝে গেছিলাম।
আমি রান্না করতে পারতাম না। আমার শ্বাশুড়ি মা হাতে ধরিয়ে সব শিখিয়েছে। আমি মাছ ভাজি ছাড়া কখনো মাছ খেতে পারি না। আমার শ্বাশুড়ি মা মাছ রান্না করলেই এখনো আমারটা তুলে রাখে শেষে ভেজে দেওয়ার জন্য। প্রথম প্রথম বাড়ির জন্য আমার মন কেমন খারাপ করতো। আমার শ্বাশুড়ি মা তখন বন্ধুর মতো মিশতো আর মজা করতো শুধু আমায় হাসানোর জন্য।আমার শ্বশুর আব্বা মা ছাড়া কখনো ডাকেনি আমায়।
এতক্ষণ ধরে কথাগুলো ভাবতে ভাবতে খেয়ালই করিনি মায়ের তৈল দেওয়া প্রায় শেষের দিকে। মাথাটা ঘুড়িয়ে দেখলাম মা এখন চুলগুলো বিনুনি করে দিচ্ছে। খানিক পরে মা বলে উঠলো,
কি ব্যাপার বউমা কিছু ভাবছো?
আমি কি বলবো ভেবে পাচ্ছি না। এতদিন ধরে মায়ের ভালোবাসাগুলো চোখে পড়লেও আজকের টা যেন ঠিক হৃদয়ে লাগলো। আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। মা আমায় চুপচাপ দেখে আমার মুখটা তারদিকে ঘুড়িয়ে দেখতেই আমি কেঁদে ফেললাম। মা বললো,
বোকা মেয়েটা কাঁদছে দেখো। ওইদিকে আমার ছেলেটা অফিস থেকে এসে যে দাঁড়িয়ে আছে কতক্ষণ ধরে সেটা কি দেখেছো হুম?
আমি মায়ের কথাটা শুনে অবাক হয়ে দরজার দিকে তাকালাম। তাকাতেই দেখি আমার স্বামী ফাইয়াজ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে দেখছে আমাদের।
আমি চোখদুটো মুছতে মুছতে বললাম,
মা, কখন এসেছে তোমার ছেলে আমায় বলবে না?
মা খানিক হেসে বললো,
আমিওতো খেয়াল করিনি পাগলটা কখন এসে আমাদের মা মেয়ের ভালোবাসা দেখে মুখ টিপে টিপে হাসছে।
মা কথাটা শেষ করে আর কিছু না বলে আমাদের রুম থেকে চলে গেলো। আমি উঠে দাঁড়াতেই ফাইয়াজ হাত বাড়িয়ে আমার মাথা ব্যথার ঔষধের প্যাকেট টা দিলো।আমি প্যাকেট টা দেখে ওর দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকাতেই ও বলে উঠলো,
মাইগ্রেনের ঔষধটা শেষ হয়ে গেছে আমার মনেই ছিলো না।তুমিও কখনো মনে করিয়ে দাওনা ঔষধ আনতে হবে।মা যদি ফোন করে না জানাতো আজতো সারারাতও ঠিক মতো ঘুমাতে পারতে না।
আমি ফাইয়াজের কথাটা শুনে বুঝতে পারলাম না কিছুই।তাই ও’কে বললাম,
-মা কি করে জানবে আমার মাথা ব্যথার ঔষধের কথা?আমিতো মা কে বলিনি কিছু।
–মা কে আমি অনেক আগেই বলে রেখেছিলাম তোমার মাইগ্রেনের সমস্যা আছে। মা আজকে রুমে এসে তোমায় অসময়ে শুয়ে থাকতে দেখেই আমায় কল করে জানায়। আমি তখন বলি হয়ত মাথা ব্যথা হয়েছে তাই শুয়ে আছো। পরক্ষণে আমার মনে হলো ঔষধগুলোওতো শেষ হয়ে গেছে। আর মা তখন ফেরার পথে মনে করে ঔষধ আনতে বলে। কিন্তু এসেতো দেখলাম মায়ের আদর পেয়ে মেয়ে একদম সুস্থ।
আমি যেন কেমন স্তব্ধ হয়ে গেলাম ফাইয়াজের কথাগুলো শুনে। এখন বুঝতে পারলাম মা শুধু তার ঔষধগুলো দেখাতেই আসেনি। কথাটা ভাবতেই যেন কেমন ভালোলাগা কাজ করলো আমার ভেতরে।ফাইয়াজ আমার ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা দেখে ভ্রু কুচকিয়ে প্রশ্ন করলো, কি হয়েছে হঠাৎ হাসছো যে?
আমি চোখদুটো বন্ধ করে একটা ভালোলাগার নিঃশ্বাস ফেলে মাথা নাড়িয়ে বুঝালাম,না কিছু হয়নি।
অথচ আমি এখন মনে মনে ভাবছি,”যাদের জন্ম থেকে দেখেছি একটা সময় তারাই আপন ছিলো। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে আজ তারা হয়ে গেছে পর। আর যাদের চিনতাম না জানতামও না আজ তারাই হয়ে উঠেছে আপনজন”।
সমাপ্ত
ধন্যবাদ লেখা গুলো পড়ার জন্য ও লেখা ভালো লাগলে শেয়ার করবেন।