the truth author

প্রিয়জন ✍ লেখিকা সোনিয়া শেখ

গল্প
প্রিয়জন
✍ লেখিকা সোনিয়া শেখ
আম্মা, আজকে সোনিয়া’কে রান্নাঘরে না পাঠালে কি হতো না?
আমার প্রশ্নটা শুনে আম্মা আমার দিকে কিছুটা অবাক হয়েই তাকিয়ে থেকে বললো,
নিয়াজ তুই কি বলতে এসেছিস পরিষ্কার করে বলতো?সকালে দেখলাম বউমার কাপড়-চোপড়গুলো ধুয়ে দিলি আবার এখন রান্না করতেও বারণ করছিস।
-আম্মা আসলে ওর শরীরটা খুব একটা ভালো নেই। না মানে সমস্যা চলছে যার জন্য সকাল থেকেই পেট ব্যথায় শুয়ে ছিলো মেয়েটা।
আম্মা আর কিছু না বলে সোজা রান্নাঘরে চলে গেলো।আমিও আম্মাকে বুঝতে না দিয়ে তার পিছু পিছু গেলাম।
আম্মা রান্নাঘরে ঢুকেই সোনিয়া কে বললো,
আচ্ছা বউমা তোমার যে শরীর খারাপ সেটা কি আমায় বললে খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেতো?
-না মা আসলে…
থাক, এখন যাও একটু বিশ্রাম নাও গিয়ে। আমি তোমার জন্য হালকা পানি গরম করে পাঠিয়ে দিচ্ছি নিয়াজের কাছে।
সত্যি আমি মাঝে মাঝে খুব বেশি অবাক হই। আম্মা অনেকটা রাগী স্বভাবের মানুষ। সবসময় খুব গম্ভীর হয়ে থাকে। এই কথাটা সোনিয়াও জানে যে আম্মা কখন ভালোবাসে আবার কখন রেগে কথা বলে বোঝা দায়।তাই আমার মতো সোনিয়াও তেমন একটা ধরে না এসব বিষয়। কিন্তু মাঝে মাঝে আম্মা এমন কিছু করে বসে যেটা সোনিয়া কেন আমি নিজেও বুঝতে পারি না। এই যেমন এখন যেটা করলো আমিতো ভেবেছিলাম আমায় বকবে। তা না করে সোনিয়ার জন্য পানি গরম করে বোতলে ভরে দিলো আমার কাছে।
আমার শৈশবের সময় বাবা মারা যায়। নানুরা আবার বিয়ে দিতে চাইলেও আম্মা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আর বিয়ে করেননি। তাছাড়াও আম্মা বাবা কে ভীষণ ভালোবাসতো যার জন্য তিনি তাকে হারানোর ব্যথাটা কখনোই ভুলতে পারেনি।
নানু বলতো তার মেয়ের মতো হাসিখুশি নাকি আর দ্বিতীয়টা নেই। সবসময় মুখে হাসি লেগেই থাকতো। কিন্তু বাবা কে হারানোর পর থেকেই এমন গম্ভীর প্রকৃতির হয়ে যায় মানুষটা।
সোনিয়ার আর আমার বিয়ের চার বছর হতে চললো।এখনো পর্যন্ত বাচ্চা কাচ্চা কেন হচ্ছে না সেটা নিয়ে পারা-প্রতিবেশীর কানাঘুঁষার শেষ নেই। মাঝে মাঝে যে যেমন পারছে আম্মার কান ভারি করেই যাচ্ছে। আম্মা অবশ্য এসব নিয়ে সোনিয়া’কে কোনো কথা বলেনি। তবে মানুষের এতো কটু কথা তাকে যে আঘাত দিচ্ছে সেটাও বুঝতে পেরেছি। কিন্তু আল্লাহ না দিলে কি কারো হাত আছে বাচ্চা দেওয়ার?
এদিকে সোনিয়াও দিন দিন বাচ্চার চিন্তায় আর প্রতিবেশীদের খোঁচাস্বরুপ কথা বার্তায় সারাক্ষণ কেঁদেই যাচ্ছে। ও’কে শত শান্তনা দিয়েও কোনো লাভ হয় না আর।
একদিন রাতে আম্মা আমায় ডাকে তার রুমে। আমি কিছুটা আন্দাজ করি কি বলতে চায় আম্মা আমায়?তবুও না বোঝার ভঙ্গিতে আম্মার রুমে গিয়ে বসলাম।আম্মা বললেন, নিয়াজ বাবা তুই আবার বিয়ে কর।
কথাটা শোনামাত্র যেন বুকের ভেতরটা কেমন ব্যথা অনুভব হলো আমার। নিজেকে কিছুটা সামলে আম্মা কে বললাম,
আম্মা বাবা কে কি তুমি এখনো ভুলতে পেরেছো?
আম্মা বাবার কথাটা শুনে চোখজোড়া ঝাপসা করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। আমি আম্মার চোখ দেখেই বুঝলাম আর কোনো কথা বলতে পারবে না।আমি আবার বললাম,
জানি পারোনি কারণ বাবা কে তুমি খুব ভালোবাসো।তেমনি সোনিয়াও আমায় ভীষণ ভালোবাসে, আর আমিও। সন্তান আল্লাহ চাইলে আরো কিছুদিন পরে দিতে পারেন, আর না চাইলে দেবেন না। তাই বলে কি সেই দোষে মেয়েটা কে কষ্ট দিতে হবে? একটা মেয়ের স্বামী হারানোর যন্ত্রণা কতটা তীব্র হতে পারে তা তোমার থেকে বেশি কেউ জানেনা। আমি পারবো না আমার স্ত্রী কে কষ্ট দিতে। সারাজীবনেও বাচ্চা না হলে আমি ওকে ছাড়তে পারবো না। এটাই আমার শেষ কথা আম্মা।
খেয়াল করলাম আম্মা মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলছে।আমি আর কিছু না বলে সোজা আম্মার পায়ের কাছে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। পা দুটো জড়িয়ে ধরে বললাম,
আম্মা আমার কথায় কষ্ট পেলে আমায় ক্ষমা করে দিও।তুমি যেমন আমার পৃথিবীর আলো দেখানোর একমাত্র প্রিয়জন তেমনি সোনিয়াও আমার শরীরের অর্ধাঙ্গ আরেকটা প্রিয়জন।তোমাদের দুজন কে ছাড়াই আমি অসহায়।
আম্মা আমায় বুকে জড়িয়ে ধরে অঝোর ধারায় অশ্রু ফেলে বললো,
আমিই ভুল ভেবেছিলাম তুই ঠিক ছিলি নিয়াজ।আমি নিজের ছেলের সুখের কথা চিন্তা করে একটা মেয়েকে অসহায় করতে চেয়েছিলাম কিন্তু তুই চোখ খুলে দিলি আমার।
নিয়াজ তুই ঠিক তোর বাবার মতোই হয়েছিস।আজ বুঝতে পারলিতো কেন তোর বাবা কে এতো বেশি ভালোবাসতাম?
দোয়া করি আল্লাহ তোদের ভালোবাসাকে এইভাবেই বছরের পর বছর একে অপরের প্রতি আরো বেশি শ্রদ্ধাশীল করুক।
আম্মার রুম থেকে চোখ মুখ মুছে আমাদের রুমে ঢুকতেই দেখলাম সোনিয়া বালিশে মুখ চেপে কাঁদছে।আমি ওর কাছে গিয়ে কাধে হাতটা রাখতেই ও আমার হাত দুটো শক্ত করে ধরে মাথা নিচু করে বসে রইলো।আমি কিছু বুঝে উঠতে না পেরে ও কে প্রশ্ন করলাম,
এই সোনিয়া কি হয়েছে তোমার কাঁদছো কেন?
ও মুখটা তুলে বললো,
আমি তোমার কথাগুলো সব শুনেছি। তুমি আমায় এতোটা ভালোবাসো আমি জানতাম না।
আমি খানিক হেসে জবাব দিলাম, ধুর বোকা মেয়ে এতে কাঁদার কি আছে? স্বামীইতো এতো ভালোবাসবে এটাই স্বাভাবিক।
সোনিয়া এবার আমার হাতদুটো ওর দু হাতের মুঠোতে নিয়ে বললো,
হুম স্বামী’ইতো ভালোবাসবে। কয়টা মেয়ের ভাগ্যে জোটে এমন স্বামী জানি না। কিন্তু আমি অনেক বেশি ভাগ্যবতী স্ত্রী যেখানে চারদিকে তাকালে শুধু স্ত্রীদের ওপর অত্যাচার, অপমান অসম্মানের কাহিনীগুলো শোনা যায় সেখানে আমি তোমার প্রিয়জন। বাচ্চা হচ্ছে না জেনেও কখনো কষ্ট দিয়ে কথা বলোনি বরং আমার প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসার এতটুকুও কমতি রাখোনি। এমন কপাল করে কয়টা মেয়ে স্বামীর ঘরে আসে বলো?সত্যিইতো একজন স্ত্রীর স্বামী তোমার মতোই হওয়া উচিৎ।
আমি সোনিয়ার চোখ মুছে দিতে দিতে বললাম,”হুম প্রিয়জন তো এমনই হবে”।
সমাপ্ত
ধন্যবাদ লেখা গুলো পড়ার জন্য ও লেখা ভালো লাগলে শেয়ার করবেন।
Exit mobile version