গল্প
সন্তান
✍ লেখিকা সোনিয়া শেখ
মা,”তুমি দশদিন ভাইয়ার ঘরে খাবে আর দশদিন আমার ঘরে”।
ছোট ভাইদের এমন তেতো কথা যেন কলিজা ছেদ করে গেলো আমার। খেয়াল করলাম মা পাথরের মূর্তির মতো বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনে যাচ্ছে।
আব্বা মারা গেছেন তিনমাসও হয়নি অথচ এখনিই মা’কে নিয়ে টানাটানি। আজকাল বাড়িতে আসতেও তেমন একটা মন চায়না। তবুও আসি অসহায় মা নামক এই মানুষটা’কে একনজর দেখতে।
আব্বা মারা যাওয়ার সপ্তাহ তিনেক পর একদিন দুপুর বেলা এসেছিলাম বাড়িতে। এসে যা দেখলাম তাতে করে আর থাকতে পারিনি চোখজোড়া মুছে শুধু মায়ের সাথে একটু কথা বলেই চলে গেছিলাম।
বাড়ির ভেতর ঢুকতেই সামনে আব্বা মা’র ঘরের জানালা পরে
দেখলাম মা ভাতের প্লেট টা হাতে ধরে নিরবে অশ্রু ফেলে যাচ্ছে। একটু খেয়াল করে দেখলাম প্লেটে রাখা তরকারির ভেতর মাছের লেজের আগের ছোট্ট পিছটা দেওয়া। আমার ভেতরটা কেমন মোচরে উঠলো। অথচ এই মা কত বছর যে নিজে না খেয়ে এই সন্তানদের খাইয়েছে তার কোনো হিসাব নেই।
এসব মনে পড়তেই আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না।চোখদুটো মুছে ভাইদের বললাম,
হায়রে সন্তান তোরা রে ভাই। আজ মা’কে নিয়ে ভাগবন্টন শুরু করে দিলি? কাল জমি অবদি ছিলি তাও ঠিক ছিলো তাই বলে নিজের জন্মদাত্রী মা তাকেও তোদের জমির মতো ভাগে ফেলতে হবে? ছিঃ তোরা যে এমন অমানুষ তৈরি হবি জানলে তোদের মতো সন্তানদের বাবা মা কষ্ট করে এত বড়’ই করতো না।
আমার ছোট ভাইটা খুব রেগেমেগেই বলে উঠলো,
আপা তুই বেশি কথা বলিস না। তোর এই বাড়িতে আর কোনো অধিকার নেই। আর তোর যদি এতই দরদ হয় মায়ের জন্য তাহলে তুই নিয়েই তোর কাছে রাখ না মা’কে…কথাটা শেষ না হতেই কষিয়ে একটা থাপ্পর দিলাম ওর গালে।
এই কথাটা শোনার পর আর ধৈর্য্য ধরে দাঁড়াতে পারলামনা। এতবছরেও যে ভাইদের গায়ে হাত তুলিনি আজ সেই আদরের ছোট ভাইয়ের গায়ে হাত তুলতে আমার হাতটাও কেন জানি কাপলো না।
কাপা কাপা গলায় বললাম,
তোদের মতো অমানুষ ছেলেদের কাছে মা’কে রাখা মানে জাহান্নামে রাখা সমান কথাই। যদি পারতাম মা’কে আমার কাছেই রাখতাম তোদের বলতে হতো নারে।কিন্তু ভাগ্য যে মেয়েদের এই নিয়ম থেকে বঞ্চিত রেখেছে।
আজ তোরা কত বড় হয়ে গেছিস তাই না? অথচ এই মায়ের হাতে তোদের ভাইদের কত যত্ন করে এত বড় করেছে তা কি জানিস? কতরাত যে পেট ভরে না খেয়ে আমাদের খাইয়েছে কোনোদিনো অভাব কি জিনিস বুঝতে দেয়নি সেটা কখনো ভেবেছিলি? মা সবসময় মাছের মাথাটা তোদের দুই ভাই কে ভাগ করে দিতো যাতে দুজনের কেউ কখনো মন খারাপ না করিস। কই সেদিনগুলোতে তো আমি মাছের মাথা নিয়ে অধিকার খাটায়নি তাহলে আজ কেন আমার অধিকার নিয়ে তোরা প্রশ্ন তুললি?
এক বেলার মাংস যখন দুইবেলা তোদের প্লেটে যেতো তখন কি একবারোও ভাবতিস কিভাবে সম্ভব হয়? যে মা’কে আজ ভাগ করছিস অমানুষের মতো সেই মা’ই তোদের নিজের মাংস’টা না খেয়ে ভাগ করে দিতো আরেক বেলার খাবার প্লেটে। আজ তোরা মা’কে নিয়ে বোঝা হিসেবে টানাটানি করছিস অথচ এই মা কে সেদিনও টানতিস কিন্তু সেটা ছিলো ‘আমার মা আমায় বেশি ভালোবাসবে তোকে কম’এই আবদারে।আজ এই তিনমাসেই মা তোদের কাছে বোঝা আর মাসের পর মাস তোদের পেটে টেনেছে কই সেদিনতো মা তোরা বোঝা বলে চিৎকার করেনি?
মা বারান্দার খুটি টা ধরে অঝোরে কেঁদেই যাচ্ছে।উঠোনে দাঁড়ানো আমার ভাই দুটো আর কোনো কথা না বলে যে যার মতো ঘরে চলে গেলো। সাথে ভাইদের বউরাও এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। জানি না তারা অনুতপ্তবোধ করবে নাকি যে যার সিদ্ধান্তেই অটল থাকবে।
আজকে আর আমি শ্বশুর বাড়ি ফিরলাম না। মায়ের কাছেই থেকে গেলাম। রাতে আমার স্বামীর সাথে কথা বলে জানালাম সকালে ফিরবো ও যেন বাচ্চাদের দেখে রাখে।
ভেবেছিলাম রাতে হয়তো ভাই দুটো এসে নিজেদের ভুলের জন্য ক্ষমা চাইবে মায়ের কাছে। কিন্তু সব উদ্ভট ভাবনা কে ফেলে দিয়ে ওরা কেউ এলো না আর।ঘন্টাখানেক পর বড় ভাইয়ের বউ এসে খাবার দিয়ে যায়। মা পাথরের মতো সেই যে শুয়ে আছে খাবার জন্য জোড় করেও কোনো লাভ হলো না আর। আমি চুপচাপ মায়ের কাছে শুয়ে পরলাম। দেখলাম বালিশের এক অংশ ভিজে একাকার।মায়ের হাতে আমার হাতটা রাখতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। যেন অনেকক্ষণ যাবত
আটকানো একটা রুদ্ধশ্বাস বের করে দিলো ভেতর থেকে। মা’কে বললাম,
ও মা তুমি ভেবো না এতো, দেখো কাল সকালেই আমার ভাইগুলো মাফ চাইবে তোমার কাছে।
মা কিছু না বলে হাতটা বুকের উপর রেখে চোখদুটো বন্ধ করে অঝোরে অশ্রু ফেলছে।কিছুক্ষণ পর চোখ মেলে শুধু বললো,
আমার কেমন বুকে অসহ্য ব্যথা করছে রে মা।
ছোটোবেলায় দাদীর মুখে শুনেছিলাম খুব অল্প বয়সে আব্বা মা’র বিয়ে হয়। মা’কে হাতে ধরে শিখিয়ে পড়িয়ে আজ এতদূর এই সংসারে মায়ের অবস্থান। আব্বা ধান,পাট,ভূট্রার ব্যপারী ছিলেন। যে মাসে ভালো কেনা বেচা করতে পারতেন সে মাসে আমরা খুব ভালোভাবে খেতে পারতাম। আর বাজার মন্দ গেলে আয় তেমন হতো না যার ফলে অনেকটাই অভাব অনটনের মাঝে কেটে যেত। আব্বা কিছু কিছু করে টাকা জমিয়ে তার সাথে মায়ের বিয়ের গয়না বিক্রি করে ভাইদের সারাবছর ঘরের ধানের চাউল খাওয়ার জন্য কিছু জমি আর আমার বিয়ের খরচা-পাতি জোগাড় করেন।
আমি তিন ভাইবোনের মাঝে বড় হওয়াতে এসবকিছুর প্রায় বিষয়ই জানতাম যা ভাই দুটো আজও জানে না।
আজ মায়ের না জানি এসব পুরোনো স্মৃতিগুলো কতবার করে মনে পড়ছে। বুকে ব্যথাতো তখনই হয় যখন বুকের ভেতরে থাকা মানুষগুলোর দেওয়া আঘাত সহ্য হয় না। মা ও যে আজ সন্তানদের দেওয়া কষ্টগুলো সহ্য করতে পারছে না।
যেখানে শেষ বয়সে এসে ছেলেদের সাথে ভালো ভাবে একটু বেঁচে থাকার কথা সেখানে তার খাওয়া, পড়া নিয়েও কত অপমান। একজন মায়ের কাছে এর চেয়ে লজ্জাজনক ঘটনা আর কি হতে পারে?
রাতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি মনেই পড়ছে না। ফজর ওয়াক্তে মুয়াজ্জিনের আজানের স্বরে ঘুম ভেঙ্গে যায়।দ্রুত উঠে ওজু করে এসে মায়ের জন্য পানি এনে বারান্দায় রাখলাম। ঘরে ঢুকে মা’কে বললাম,
ও মা উঠে পড়ো আজান হয়েছে, আমি নামাজে দাঁড়ালাম।
শেষ রাকাতে এসে সালাম ফিরিয়ে পিছনে বিছানার দিকে ঘুরে তাকালাম একবার। মা এখনো ঘুমিয়েই আছে।আমার কেমন যেন অদ্ভুত লাগলো ব্যপারটা। মা তো এক ডাকেই উঠে পরে আর আজ এমন কি হলো?
আমি মোনাজাত শেষ করে জায়নামাজ টা খানিক ভাজ করে মায়ের কাছে গেলাম। মা’র শরীরটা ছুঁতেই দেখলাম ঠান্ডা বরফ হয়ে আছে। আমার কলিজাটা দুমড়ে মোচরে উঠলো চোখজোড়া মুহূর্তেই ঝাপসা হয়ে এলো।মা’র মুখের কাছে হাতটা রাখতেই দেখলাম শ্বাস চলাচল বন্ধ। ও মা বলে একটা চিৎকার দিয়ে মেঝেতে পড়ে গেলাম।
ভাইয়েরা,পারা-প্রতিবেশীরাসহ সেই দমফাটা চিৎকারে যে যার মতো দৌঁড়ে এলো ঘরে। আমার মা বিছানায় অবুঝ শিশুর মতো শুয়ে আছে যেন কাল বুকে ব্যথার এতো যন্ত্রণা সবটা ভুলে গেছে।
ছোট ভাইটা মা বলে কান্না করতে করতে মায়ের পায়ের কাছে বসে পরলো আর বড় ভাইটা মায়ের মাথার কাছে বোবা হয়ে অশ্রু ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আমায় প্রতিবেশীরা শক্ত করে ধরে রইলো যার যত দেহের শক্তি দিয়ে।কিন্তু আমি পাগলের মতো চিৎকার করতে লাগলাম,ও মা..মা..ওঠো না ও মা মাগো কথা বলো না কেন কি হইছে তোমার?
আমার বড় ভাই মা’কে স্পর্শ করতেই আমি কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলাম,
তোরা ছুঁইবি না আমার মা’কে। এটা আমার মা তোদের না। তোরা তোদের মা’কে কাল নিজের হাতেই মেরে ফেলেছিস।
আমি কতবার জ্ঞান হারিয়েছি জানিনা। চোখ খুলেই আবার ওমা মা করে চিৎকার করে উঠলাম। বাড়ি ভরতি গোলাপ জলের ঘ্রাণ। কিন্তু মা যখন কোনো মৃত বাড়িতে যেত তখন শুধু বলতো, মা রে আমার না এই ঘ্রাণ টা শুকলে কেমন যেন ভয় করে। মনে হয় এই বুঝি জীবন শেষ। আর আজ এতো ঘ্রাণ তবুও মা একটুও নড়াচড়া করছে না।
শেষবারের মতো মায়ের মুখটা দেখানো হলো। আল্লাহ্ জীবনের কোনো মুহূর্তেও এমন কলিজা পোড়া কষ্ট দেয়নাই যতটা কষ্ট মায়ের মুখখানা শেষবারের মতো দেখতে হয়।
আমার ভাইদুটো এখন পাগলপ্রায় কিন্তু কে দেখছে ওদের মায়ের প্রতি এতো ভালোবাসা? কেউ দেখবে না আর কেউ আর একমুঠো ভাতের জন্য নির্লজ্জের মতো ওদের দ্বারে দাঁড়াবে না।
বুকে পাথর বেধে ধৈর্য্য আনলাম। কাঁদলে যে আমার মায়ের আত্মা কষ্ট পাবে। তবুও যেন কান্না আজ থামে না।
মায়ের দাফন শেষে সবাই বাড়িতে আসলে আমার ভাইয়েরা আমার স্বামী’কে প্রশ্ন করে, ছেলেরা থাকতেও কেন মেয়ের টাকায় কাফনের কাপড় কেনা হলো?
আমায় তখন মায়ের ঘরে মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। প্রশ্নটা শুনে আমি ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে আসলাম। এতো কষ্ট বুকে নিয়েও তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললাম,
হু ছেলে? তোদের কথাটা শুনে আমার আজ ভীষণ হাসতে ইচ্ছে করছে রে। তোরা ছেলে তাইনা? তা ছেলের দায়িত্ব কি পালন করেছিলি এতদিন? মায়ের খোঁজ রাখতি কখনো? যে ছেলেরা একবেলা খাবারও ভাগ করে দিতে চায় সেই ছেলেদের টাকায় কেন কাফনের কাপড় কিনতে হবে বল? তাহলেতো সেটাও ভাগ করে নিতি যে কে কত টাকা দিবি তাইনা?
কাল ঠিকই বলেছিলি তোরা, এই বাড়িতে সত্যিই আমার আর কোনো অধিকার নেই। আজকের পর থেকে তোদের আব্বা, মা আর আপাও মারা গেছে।
শেষ একটা কথা বলি মনে রাখিস,
“তোদের সন্তানকে এমন শিক্ষা দিস যা আমার আব্বা মা তোদের কোনোদিন দিতে পারেনি”।
(ছেলে সন্তানও সন্তান আর মেয়ে সন্তানও সন্তান।বাবা মা তো কোনো সন্তান’কে আলাদা চোখে দেখে না।তাহলে আপনাদের ছেলেদের দৃষ্টিভঙ্গি এতো আলাদা হয় কেমন করে? কেন বাবা মা’কে একটা মেয়ে যতটা ভালোবাসতে পারে আপনি ছেলে সন্তান ততোটা বাসতে পারেন না? ভালোবাসাটা শুধুই অন্তরের আর অন্তরটা পরিষ্কার রাখুন বাবা মা’কে সেই জায়গায় রাখুন যে জায়গাটা একদিন আপনিও আপনার সন্তানের থেকে আশা করেন। একবার বিবেক নাড়িয়ে ভেবে দেখুন আজ এত বড় কাদের জন্য হয়েছেন। আপনার বউয়ের কোনো সাধ্য নেই আপনার মনে বাবা মায়ের প্রতি বিষ ঢুকানোর। হ্যা যদি শুধুমাত্র আপনি সঠিক হয়ে থাকেন।)
সমাপ্ত
ধন্যবাদ লেখা গুলো পড়ার জন্য ও লেখা ভালো লাগলে শেয়ার করবেন।